নারীবান্ধব বঙ্গবন্ধু

4063

Published on মার্চ 8, 2020
  • Details Image

পূরবী বসুঃ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী-পুরুষের সমকক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন। আর নারী উন্নয়নের পক্ষে তার এই প্রগতিশীল অবস্থান ঘরের অভ্যন্তরে ও বাড়ির বাইরে বৃহত্তর রাজনীতিতে- উভয় স্থলেই প্রতিফলিত হয়। নোবেল বিজয়ী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের মতে, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য যে উন্নত অবকাঠামো, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সুশাসন প্রয়োজন- এর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে যে অভাবনীয় অর্জন সম্ভব হয়েছে, তা মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতি কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট নারীনেত্রী ও সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা সালমা খান একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, “প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা, মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা, জনসংখ্যার আধিক্য ও সুশাসনের অভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ শুধু ‘উন্নয়নের ধাঁধা’ই সৃষ্টি করেনি, সেই সঙ্গে এক অপার সম্ভাবনার দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।”

বিশ্বব্যাংকের মতে, স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যআয়ের দেশে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলের মতে, বিশ্বের ১১টি সম্ভাবনাময় দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এখন জগৎজুড়ে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর বিশেষ অবদান রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শ এবং নারীকল্যাণে নিয়োজিত দেশের এনজিওগুলোর কল্যাণে দেশে অবকাঠামো, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শ্রম (বিশেষ করে পোশাক, নির্মাণশিল্প, গার্হস্থ্য, মৎস্য, পোলট্রি ও কৃষিকাজ), এমনকি পুলিশ ও মিলিটারিসহ প্রতিটি সরকারি কার্যকর্মে সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে নেতৃত্বের ভূমিকায় অধিষ্ঠিত আজ নারী। এতে সন্দেহ নেই যে, বঙ্গবন্ধুর নারী উন্নয়ন ভাবনা ও দর্শনের বিশেষ অবদানের জন্যই বাংলাদেশের এই ধরনের অভাবনীয় উন্নতি এমন দ্রুতগতিতে ঘটা সম্ভব হয়েছে।

‘বঙ্গবন্ধু’ তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই আমাদের দেশের নারীর অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে গভীরভাবে চিন্তিত ছিলেন এবং তাদের ক্ষমতায়নে বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনিই প্রথম ’৭২-এর সংবিধানে নারীর অধিকারের বিষয়টি সংযোজন করেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা ও সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে প্রতি পদক্ষেপে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছিলেন। ফলে পুরুষের সঙ্গে নারীর সমকক্ষতার বিষয়টি আওয়মী লীগের মূল এজেন্ডার অন্তর্গত হয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার কার্যকর্মের সঙ্গে অনেক নারী নেতৃত্বের নাম সম্পৃক্ত রয়েছে- বদরুন্নেছা আহমেদ, আমেনা বেগম, জোহরা তাজউদ্দীন প্রমুখ। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে ৯ নারী নেত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আনোয়ারা বেগম, দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুর্শিদ, বদরুন্নেছা আহমেদ, সেলিনা হোসেন ও আমেনা বেগম পরবর্তীকালে জাতীয় আন্দোলনের মূলধারার নেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। জোহরা তাজউদ্দীন স্বাধীনতার আগে যেমন ভূমিকা রেখেছেন, তেমনি পরবর্তীকালেও দলের যে কোনো দুঃসময়ে, ক্রান্তিকালে হাল ধরেছিলেন।

দেশ ও দলের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তার জীবনের ধ্যান-ধারণা। আমৃত্যু একনিষ্ঠভাবে সবার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী দলের সুদিন-দুর্দিনে দলকে করেছেন সংগঠিত। দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন, এখনো মিশে আছেন দলের সঙ্গে। আইভি রহমান নারী নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল নাম। অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন নারীদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে। তার সংগঠনের প্রতি ভালোবাসা ছিল অমলিন। প্রাণ উৎসর্গ করেছেন স্বদেশের কল্যাণে রাজনীতি করে, বিশেষ করে দলের নারী কর্মীদের সুগঠিত করার কাজে। স্বাধীন দেশে শান্তিপূর্ণ জনসভায় যোগদান করতে গিয়ে গ্রেনেড হামলায় মর্মান্তিক অকাল মৃত্যুবরণ করেন আইভি।

এ ছাড়া প্রতিটি জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে আছেন নিবেদিতপ্রাণ নারী। প্রতিকূল পরিবেশ, সামাজিক নানা ধরনের বৈষম্যকে ঠেলে আঁকড়ে আছেন তারা দলের সঙ্গে। প্রাথমিক পর্যায়ে নারীরা এই উপমহাদেশে রাজনীতিতে আসেন মূলত বামপন্থি বা নারী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে। বাম দল থেকে পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে আওয়ামী লীগে চলে আসেন কোনো কোনো বাম নারীনেত্রী।

এদিক থেকে অন্যতম প্রধান উদাহরণ বেগম মতিয়া চৌধুরী। বামপন্থি রাজনীতি থেকে আসা বেগম মতিয়া চৌধুরী তার স্বচ্ছতা, সততা ও ঐকান্তিকতা দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে মুক্ত বাতাসের আবির্ভাব ঘটিয়েছিলেন। নারী নেতৃত্বের ওপর বঙ্গবন্ধুর অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা এই আগমনকে ত্বরান্বিত করেছিল। সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাস সাক্ষী দেয়- নারীনেত্রীরা কখনো দলের দুর্দিনে দলের সঙ্গে প্রতারণা বা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তাই বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরতা ছিল তাদের ওপর।

নারীর উন্নয়ন ছাড়া দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়- এ গভীর উপলদ্ধি থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর নারীসমাজের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশকে উপহার দেন ’৭২-এর অত্যাধুনিক ও অনন্য সংবিধান- যাতে কেবল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথাই বলা হয়নি, অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে এতে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতীয় সংসদে সর্বপ্রথম জাতির পিতা নারীদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত করেন। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্যও প্রতিবন্ধকতামূলক আইন তুলে দিয়ে নারী সহায়ক আইনের সংযোজন করেন।

বাংলাদেশের নারী জনগোষ্ঠী রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পারিবারিক ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনগ্রসর থাকায় বাংলাদেশের সংবিধানে তাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার সন্নিবেশিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত প্রথম ও মূল সংবিধান এবং পরবর্তীকালে কয়েকটি সংশোধনীতে তাদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ও সংরক্ষিত অধিকার দেওয়ার কথা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সংযোজন করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম উৎস ’৭২-এর সংবিধান। এর উপর ভিত্তি করেই নারীর ক্ষমতায়নের বিভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

১৯৭২ সালের নবগঠিত সংবিধানে বঙ্গবন্ধু নারী-পুরুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন ধারা পড়লেই তা বুঝতে পারা যায়। এ সংবিধানে নারীদের জন্য সংসদে ১৫টি আসন সংরক্ষিত করা হয়। তা ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে অর্ধশতকে এসে ঠেকেছে। সংরক্ষিত আসন ছাড়াও প্রত্যক্ষ নির্বাচনে পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারী এখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুসরণ করে বর্তমান সরকার নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। স্থানীয় সরকারে তাদের অন্তর্ভুক্তিও বাধ্যতামূলক আজ। বিদ্যালয়ে নারীশিক্ষা অবৈতনিক করে দেওয়ায় নারীরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষায় বিস্ময়কর গতি এবং পরিসরে এগিয়ে গেলেও পুরুষের তুলনায় উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষায় এখনো পিছিয়ে আছে। এটি পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করছে বর্তমান সরকার। এই সমস্যা সমাধানে বাল্যবিয়ে রোধ ও সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রধান দুটি চ্যালেঞ্জ।

শুধু বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র বা রাজনীতিতে নয়, ঘরোয়াভাবেও বঙ্গবন্ধু সব সময় সংসারে নারীর নীরব অবদানের কথা স্বীকার করতেন। বিশেষ করে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছার ভূমিকা ও স্বার্থত্যাগের প্রশংসা সব সময় করতেন। স্ত্রীর দূরদর্শিতা, ধৈর্য ও সাহস তাকে জনগণের জন্য সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তিনি বলতেন, একদা শিশুকালে বিবাহিত চাচাতো বোন ফজিলাতুন্নেছা যে এত বড় মাপের মানুষ ও পরম ধৈর্যশীল স্ত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন-এটি আগে বোঝা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের কয়েকটি বিশেষ ক্রান্তিকালে তিনি সুপরামর্শ ও সৎসাহস দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে উৎসাহিত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু যে তার আত্মজীবনী ও কারারুদ্ধ দিনগুলোর বিষদ বর্ণনা দিয়ে দুইখানি গ্রন্থ রচনা করেছেন, তা কেবল স্ত্রীর পুনঃপুন তাগাদা এবং জেলে থাকাকালীন তাকে খাতা-কলম কিনে দিয়ে বারবার উৎসাহ দেওয়ার ফলেই সম্ভব হয়েছে। বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা ও তিন পুত্রের জনক হওয়া সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গেই বেশি নৈকট্য বোধ করতেন এবং রাজনীতি, তার স্বপ্ন ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার সঙ্গেই বেশি আলাপ করতেন। ভাইবোনের মধ্যেও তিনি তার মেজআপার সঙ্গেই সবচেয়ে নৈকট্য অনুভব করতেন। ওই সত্তরের দশকেও তিনি সাগ্রহে বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে বরণ করে নিয়েছিলেন তখনকার দিনের মস্ত বড় খেলোয়াড় ও সাঁতারু সুলতানা কামালকে।

বাংলাদেশের নারীসমাজ এবার বিশ্ব নারী দিবসে নারীবান্ধব বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞানী

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত