বাংলাদেশের স্বাধীনতার দুর্জয় আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু

2445

Published on মার্চ 9, 2020
  • Details Image

ড. শিরীন আখতারঃ

ধর্মীয় জাতিসত্তাবিশিষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে শাসিত হওয়ার প্রাথমিক অবস্থা থেকে বাঙালি জাতির অনেকেই তাদের কী অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ রচিত হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে অনেকটা আঁচ করতে পেরেছিল। যতই দিন যাচ্ছে ততই তাদের উপলব্ধি তীব্র হতে শুরু করে। রাজনীতিক থেকে শুরু করে ছাত্রসমাজ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধতে থাকে। এই আকাঙ্ক্ষাকে নিজের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে এমনভাবে স্বাধীনতার সোপান তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, যা সে সময়ের অনেক বড় নেতার পক্ষে চিন্তা করাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ কারণেই বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক এবং অভিন্ন সূত্রে বাঁধা পড়ে আছেন।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল—এ ২৪ বছরে পাকিস্তান অধিকৃত বাংলার রাজনীতি ও সাহিত্য-শিল্প-দর্শন-সংস্কৃতি প্রতিবাদ-প্রতিরোধ-সংরক্ষণগত কারণে স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বে বিকশিত ও বহুলাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইংরেজ শাসনামলে যে ঔপনিবেশিক, আধাসামন্ততান্ত্রিক সমাজের পত্তন ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলেও সমাজের চরিত্র পুরোপুরি তা-ই থেকে গিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থার সেই উত্তরাধিকার নিয়েই সমাজের মানুষকে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় জাগ্রত করে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাঙালি মানস গঠনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজনীতির শুরুতেই তিনি হাত দিয়েছিলেন তাঁর দলকে একটি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বদল ঘটাতে। ১৯৫৫ সালের আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এক বক্তৃতায় বলেন, “প্রতিষ্ঠানকে অসাম্প্রদায়িকীকরণ প্রসঙ্গে এ কথা অনস্বীকার্য, যে সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম হয় তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি ‘সাম্প্রদায়িক’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল; কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে পাকিস্তানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক জোট হিসেবে গণ-আন্দোলনের নেতৃত্ব করার মহান দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা ঘোষণা করতে পারি যে দেশের সব ধর্মের, সব বর্ণের এবং সব ভাষাভাষীর মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়োজন। বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায়-নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম।”

বাঙালির অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৈন্যদশার কারণ বের করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতি যাঁকে তাদের জাতির পিতার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। পাকিস্তানি সামরিক শাসক ক্ষমতা পেয়ে যখন প্রতিটি বাঙালির কণ্ঠকে রুদ্ধ করে দিতে লাগল, চোখে ধর্মের চশমা লাগিয়ে দেশটিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রাখল তখন ১৯৫২-৬৬ এই কয়টি বছরে অন্ধকারের নিভৃতে অর্থাৎ শত জেল-জুলুম, অত্যাচারের মধ্যেই নীরবে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ খসড়া প্রস্তুত করে নিলেন। অর্থনৈতিক সাম্য ছাড়া জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় ঐক্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। বঙ্গবন্ধু তাই বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালের ১০ মার্চ পিণ্ডিতে যে সর্বদলীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

এই সনদ সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ভুট্টো মন্তব্য করেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যে ধরনের স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে তাকে আর প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন বলা চলে না, ওদের দাবি তো স্বায়ত্তশাসনের চেয়েও বেশি, প্রায় সার্বভৌমত্বের কাছাকাছি।’ অর্থাৎ পাকিস্তানি শাসকরা বুঝেছিলেন বাঙালির আন্দোলনের লক্ষ্য কী। তাই অস্ত্র দিয়ে দাবিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন বাঙালিকে। ৭ই মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি এক অকৃত্রিম দরদ ফুটে উঠেছিল গরিব মেহনতি মানুষের প্রতি—ক. আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে; খ. দেখে যান কিভাবে আমার গরিবের ওপর, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছে; গ. গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে।

২৩ মার্চ ১৯৭১, ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসভবনের সামনে এক বিরাট গণসমাবেশে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বললেন, “আমরা তা বরদাশত করব না। আমাদের দাবি অত্যন্ত স্পষ্ট, ন্যায়সংগত এবং ওদের তা মেনে নিতে হবে। কোনো রকম ‘রক্তচক্ষু’ দেখিয়ে লাভ নেই। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। আমরা কোনো শক্তির কাছে মাথা নত করব না। আমরা বাংলাদেশের জনগণকে মুক্ত করবই। আমাদের কেউ কিনতে পারবে না। সংগ্রাম আরো তীব্রতর করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য অধিকার আদায়ের ভয়াবহ সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। সাত কোটি বাঙালি আর দাস হয়ে থাকবে না।”

বাস্তব ক্ষেত্রে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে—বাঙালি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। গণহত্যা ও অস্ত্রের ভাষার জবাব অস্ত্র দিয়ে প্রদর্শন করতেও পারদর্শিতা দেখিয়েছে। কোনো প্রতিবন্ধকতাই আমাদের মুক্তিবাহিনীকে হতোদ্যম করতে পারেনি। ১১টি সেক্টরেই মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা অকুতোভয়ে লড়াই করেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার প্রতিটি অঞ্চলে আমাদের দামাল ছেলেদের লড়াইয়ের কাহিনি আজ স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। এসব লোকগাথার কথা বলতে গেলে অর্থাৎ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই শহীদদের আত্মদানের ইতিহাস লিখতে গেলে—যাঁর ইস্পাতকঠিন নেতৃত্বের ডাকে বাঙালি সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই সংগ্রামী মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা আমাদের উচ্চারণ করতেই হবে। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অনাহার, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগোব না, আমরা তাকাব এমন এক পৃথিবীর দিকে, যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যৎ হবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। বিশ্বের সব সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বণ্টনের দ্বারা এমন কল্যাণের দ্বার খুলে দেওয়া যাবে সেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে।’

এই লক্ষ্য নিয়েই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে হাত দিয়েছিলেন জাতির জনক। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে জনগণকে কখনো পূর্ণ মানবাধিকার ভোগ করতে দেওয়া যায় না। বাংলাদেশের ইতিহাসেই একমাত্র ব্যতিক্রম। স্বাধীনতা লাভের মাত্র ৯ মাসের মাথায় মানবাধিকার সুরক্ষিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ সংবিধান উপহার দেয় বঙ্গবন্ধু সরকার। বঙ্গবন্ধুর চিন্তার প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা—যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ শুধু তা-ই নয়, স্বাধীনতাসংগ্রামের কারণে এক কোটি মানুষের দেশ ত্যাগের ঘটনাও বিশ্বের ইতিহাসে নজিরবিহীন। যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থাকা সত্ত্বেও এক বছরের কম সময়ের মধ্যে দুই কোটি মানুষের পুনর্বাসন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছিল।

লেখক : উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকাশঃ দৈনিক কালের কণ্ঠ (৯ মার্চ ২০২০)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত