ছোটবেলায় খেলার মাঠের নেতা ছিলেন, স্বাধীনতার পর কর্মক্ষম জাতি গড়তে চেয়েছেন

1807

Published on মে 11, 2021
  • Details Image

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ, গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন ক্রীড়াপ্রেমী। দেশ স্বাধীনের পর তাই ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে নিয়েছিলেন যুগোপোযুগী পরিকল্পনা। তার সময়োচিত সিদ্ধান্তগুলোই আজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সাফল্যের শিখরে। ক্রীড়ার প্রতি ঝোঁক থেকেই, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই বঙ্গবন্ধু নজর দিয়েছেন ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নে। ১৯৭২ সালে গঠন করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড, যা বর্তমানে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) নামে পরিচিত। শুধু তাই নয় ক্রীড়ার সমন্বয় ও সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য একই বছরে (১৯৭২) প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশ ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এটি এখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (বিকেএসপি) হিসেবে পরিচিত, যা বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অন্তর্ভুক্ত ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা। এই সংস্থাই এখন বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রায় ৪৫টি খেলাধুলা বিষয়ক পৃথক সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে। যার মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) অন্যতম। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ এই সংস্থা বাফুফে-ও প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ১৯৭২ সালে। স্বাধীনতার পর, ক্রীড়াঙ্গনের সার্বিক বিকাশের প্রয়োজনীতা অনুভব করে তিনি ক্রীড়া ও যুব মন্ত্রণালয় গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তিনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যদের জন্য চাকরির সুব্যবস্থা করে দেন এবং তাদের সার্বিক দায়িত্ব নেন।

এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। ফুটবলার ক্রীড়াবিদদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে তিনি 'বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল আইন' পাশ করেন। ১৯৭৫ সালের ৬ আগস্ট, তিনি খেলোয়াড় ও তাদের পরিবারদের পাশে থাকার স্বার্থে এবং সার্বিক সহযোগিতা দেওয়ার লক্ষ্যে 'বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ পরিষদ' নামে একটি প্রস্তাব অনুমোদন দেন। কিন্তু পরিবারসহ তাকে বর্বরভাবে হত্যার পর সেটির বাস্তবায়ন থেমে যায়। তবে, প্রায় চার দশক পর, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে 'বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী কল্যাণ পরিষদ, আইন ২০১১' পাশ করিয়ে আনেন এবং বর্তমানে সেই আইনের ধারার প্রয়োগ হচ্ছে বিভিন্নভাবে।

সব খেলার প্রতি দুর্বলতা ছিল ক্রীড়াপ্রেমী বঙ্গবন্ধুর। তবে, ফুটবলের জন্য একটু বিশেষ দুর্বলতা ছিল তার। ফুটবল মাতানোর পাশাপাশি ভলিবল ও হকিতেও নিজের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি।

ঢাকা ওয়ান্ডারর্স ক্লাব ও বঙ্গবন্ধু

কিন্তু স্কুল বা কলেজ মাঠ নয়, বঙ্গবন্ধু আলো ছড়িয়েছেন আরো বড় পরিসরেও। খেলেছেন বিখ্যাত এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ঢাকা লীগের সবচাইতে সফলতম ক্লাব 'ঢাকা ওয়ান্ডারর্স' এ। জেলা দলের হয়ে নানান টুর্নামেন্ট অংশগ্রহণের পরে, ১৯৪১ সালে ওয়ান্ডার্স ক্লাবে তিনি যোগ দেন স্ট্রাইকার হিসেবে। পরবর্তীতে দুই বছর নিয়মিত সেকেন্ড ডিভিশন খেলেছেন। অধিকাংশ সময় 'নয় বা দশ' জার্সিই পড়তেন, আবার দলটির অধিনায়কত্বও করেছেন। তার নেতৃত্বে ওয়ান্ডার্স ক্লাব বগুড়ায় অনুষ্ঠিত একটি টুর্নামেন্টেও জয়লাভ করে এবং টুর্নামেন্টের ফাইনালে জোড়া গোল করেছিলেন তিনি।

গজনবী নামে তৎকালীন সুপরিচিত এক ফুটবলার বঙ্গবন্ধুর খেলা দেখে বলেছিলেন, 'তিনি যদি রাজনীতিতে না জড়িয়ে খেলা চালিয়ে যেতেন, তাহলে আমরা নিশ্চিতভাবেই এশিয়ার প্রথম সারির একজন স্ট্রাইকার পেতাম।' শুধু ফুটবল খেলার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি তিনি। পাশাপাশি ওয়ান্ডার্স ক্লাবের ভলিবল ও হকি দলেরও সদস্য ছিলেন।

স্কুল জীবনের খেলাধুলার স্মৃতি

বঙ্গবন্ধু নিজেও ফুটবল খেলতেন। ক্রীড়ার সঙ্গে তার আবেগ কতটা জড়িয়ে ছিল, সেই গল্পটা তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম। আব্বা আমাকে বাধা দিতেন না, শুধু বলতেন, লেখাপড়ার দিকে নজর দেবে। লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হতো, তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।’

‘১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বংসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, “কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।”

আমি বললাম, “আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা।” গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, “তোমাদের বাপ-ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।”

আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন, “মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মান। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।” আমি বললাম “স্যার, আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই-চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব।” এবছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর 'এ জেড খান শিল্ডের' এই শেষ ফাইনাল খেলা। হেডমাস্টার বাবুর কথা মানতে হলো। পরের দিন সকালে খেলা হলো। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।’

স্বাধীন দেশে প্রথম টুর্নামেন্ট আয়োজন

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেই ম্যাচের সাক্ষী আজকের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম। দেশের তখনকার তারকা ফুটবলারদের সমন্বয়ে ম্যাচটি আয়োজিত হয়। বাংলাদেশ একাদশ ও রাষ্ট্রপতি একাদশের মধ্যে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭২ সালের মে মাসে, ঢাকায় খেলতে আসে ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম সেরা দল কলকাতা মোহনবাগান। প্রথম ম্যাচে কলকাতা মোহনবাগান ঢাকা মোহামেডানকে হারালেও, পরের ম্যাচে হারতে হয়েছিল সফরকারীদের।

মাঠে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। ম্যাচের আগে খেলোয়াড়দের উজ্জ্বীবিত করেছেন। প্রথম হারের পর, খেলোয়াড়দের মনোবল চাঙ্গা করেছেন। সেই ম্যাচ ১-০ ব্যবধানে জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিল ঢাকা মোহামেডান। সেই ঐতিহাসিক জয়ের ম্যাচে গোল করেছিলেন কাজী সালাউদ্দীন।

দেশের ফুটবলকে পরিচিত করতে আন্তর্জাতিক ক্লাবকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার পরের বছরেই (১৯৭৩) রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামো ক্লাবকে নিয়ে আসেন ঢাকায়, প্রীতি ম্যাচ খেলার জন্য। ছোট ছেলে শেখ রাসেলকে নিয়ে সেবার ভিআইপি গ্যালারিতে বসে ঢাকা একাদশ ও রাশিয়ার মিন্সক ডায়নামোর খেলা উপভোগ করেছেন তিনি।

খেলোয়াড়দের প্রতি তার যে বিশেষ ভালোবাসা আছে, সেটা বিভিন্ন সময় প্রকাশ করেছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়েছিল আমাদের ফুটবল দল। খেলোয়াড়দের গণভবনে ডেকেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাওয়ার আগে ফুটবলারদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এই বাঙালি।

শুধু বঙ্গবন্ধু নন, তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও খেলাধুলার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শেখ কামাল ও শেখ জামালও দেশের ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য অবদান রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালকে বলা হয় স্বাধীন বাংলার আধুনিক ক্রীড়াক্ষেত্রের অগ্রদূত। বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলা।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত