বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্য

1045

Published on সেপ্টেম্বর 4, 2021
  • Details Image

ড. এম. ওসমান গনি তালুকদারঃ

আমরা সবাই জানি, বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের কিছু অপ্রকাশিত তথ্য সম্মানিত পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করতে চাই। কিছুদিন আগ পর্যন্ত যা আমার জানা ছিল না এবং আমার ধারণা আপনাদের মধ্যে অনেকেরই তা জানা নেই। আর তা হলো, তার শাসনামলের অভাবনীয় বা বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সফলতা। এ বিষয়টিকে পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত এই তিন দেশের সমসাময়িক কালের অর্থনৈতিক অবস্থার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো (তথ্যসূত্র: বিশ্বব্যাংক)।

অর্থনৈতিক অবস্থা বোঝার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হচ্ছে মাথাপিছু আয় এবং মোট দেশজ সম্পদ বা জিডিপি। তাই, প্রথমে মূলত মাথাপিছু আয় এবং পরে কিছুটা জিডিপি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো- ১৯৭২ সালে মাথাপিছু আয়: পাকিস্তানে ১৫২ ডলার, ইন্ডিয়ায় ১২৩ ডলার এবং বাংলাদেশে মাত্র ৯৪ ডলার। স্পষ্টত সর্বোচ্চ অবস্থানে পাকিস্তান, দ্বিতীয় অবস্থানে ইন্ডিয়া এবং সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ।

১৯৭৩ সালে: ইন্ডিয়ায় ১৪৪ ডলার, বাংলাদেশে ১২০ ডলার এবং পাকিস্তানে ১০০ ডলার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থানে ইন্ডিয়া, দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ এবং সর্বনিম্ন অবস্থানে ছিল পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের এক বছরের মধ্যেই পাকিস্তানের অবস্থান সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন অবস্থায় নেমে যায় আর বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে একই দেশ হওয়ার পরও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় বেশি ছিল। যেমন, ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৭৯ ডলার এবং পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ১৩৪ ডলার। এতে প্রতীয়মান হয় যে, পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কখনই সম্পদের সুষম বণ্টন করেনি। বরং সবসময় পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করত।

১৯৭৪ সালে: বাংলাদেশে ১৮২ ডলার, ইন্ডিয়ায় ১৬৩ ডলার এবং পাকিস্তানে ১৩৫ ডলার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থানে বাংলাদেশ, দ্বিতীয় অবস্থানে ইন্ডিয়া এবং সর্বনিম্ন অবস্থানে পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে যায় আর পাকিস্তান সর্বনিম্ন অবস্থায় চলে যায়।

১৯৭৫ সালে: বাংলাদেশে ২৭৮ ডলার, পাকিস্তানে ১৬৮ এবং ইন্ডিয়ায় ১৫৮ ডলার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থানে বাংলাদেশ, দ্বিতীয় অবস্থানে পাকিস্তান এবং সর্বনিম্ন অবস্থানে ইন্ডিয়া। স্পষ্টত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের তৃতীয় বছরে বাংলাদেশ তার সর্বোচ্চ অবস্থান শুধু ধরেই রাখেনি বরং অন্যদের তুলনায় প্রবৃদ্ধির মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে নেয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের তুলনায় ৬৪% (১.৬৪ গুণ) এবং ইন্ডিয়ার তুলনায় ৭৬% (১.৭৬ গুণ) বেশি হয়।

বাংলদেশের ইতিহাসে আগের বছরের তুলনায় মাথাপিছু আয়ের সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি ঘটে ১৯৭৫ সালে (৫২.৭৫%), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটে ১৯৭৪ সালে (৫১.৬৭%), এবং তৃতীয় সর্বোচ্চ ঘটে ১৯৭৩ সালে (২৭.৬৬%)। এই তিনটি ঘটনাই ঘটে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। কাজেই, বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৪%। এই ধারা অব্যাহত থাকলে ১৯৮৫ সালের শেষ নাগাদ আমাদের মাথাপিছু আয় দাঁড়াত ১৩ হাজার ডলারেরও বেশি (প্রকৃতপক্ষে ছিল ২৪৫ ডলার)।

সাদামাটাভাবে কোনো দেশের মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলারের বেশি হলে সেই দেশকে উন্নত দেশ হিসাবে গন্য করা হয়। কাজেই বলা যেতে পারে, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে এবং তিনি পরবর্তীতে ১০ বছর বেঁচে থাকলে বাংলাদেশ সত্যিই সেই দশ বছরে উন্নত দেশের মর্যাদায় আসীন হতো।

এবার দেখা যাক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের তুলনায় কেমন হয়েছিল।

১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ১৯৭৫ সালের ২৭৮ ডলার থেকে প্রায় অর্ধেকে নেমে দাঁড়ায় ১৪১ ডলার। একই সময়ে পাকিস্তানে ছিল ১৯১ ডলার এবং ইন্ডিয়ায় ১৬১ ডলার। অর্থাৎ সর্বোচ্চ অবস্থানে পাকিস্তান এবং সর্বনিম্ন অবস্থানে বাংলাদেশ। স্পষ্টত বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দুই বছরের মধ্যে আমাদের মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে যায় আর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার এক বছরের মধ্যে তা আবার সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যায় এবং তা ২০১৫ সাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪০ বছর ধরে অব্যাহত থাকে।

অপরপক্ষে, এর ঠিক উল্টা অবস্থা ঘটে পাকিস্তানে। যেমন: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এক বছরের মাথায় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় তিন দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে যায় এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে তা আবার সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে যায়।

পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে ১৯৭৩ সালে; যখন তাদের মাথাপিছু আয় আগের বছরের তুলনায় কমে যায় ৫২ ডলার। অপরপক্ষে, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে, অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে, যখন আমাদের মাথাপিছু আয় আগের বছরের তুলনায় কমে যায় ১৩৭ ডলার।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৩৪ ডলার এবং ৯ মাস স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ৪০ ডলার কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৯৪ ডলারে। স্পষ্টত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালে ৯ মাস ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি করেছে (২.৫ বিলিয়ন ডলার), ১৯৭৫ সালে শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় এক বছরের মধ্যে তার তুলনায় সাড়ে তিনগুনেরও বেশি (৯.৩৫ বিলিয়ন ডলার) ক্ষতি হয়েছিল। আবার ১৯৭৭ সালে আমাদের মাথাপিছু আয় আগের বছরের তুলনায় ১০ ডলার কমে দাঁড়ায় ১৩১ ডলারে যা ৬ বছর আগের অর্থাৎ ১৯৭১ সালের তুলনায়ও ৩ ডলার কম। যার অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায় এই যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং তাদের দেশি ও বিদেশি দোসররা বাংলাদেশের অর্থনীতি পঙ্গু করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, পাকিস্তানি আমলই ভালো ছিল এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে আমরা ৬ বছর পিছিয়ে গিয়েছি।

অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপর্ণ সূচক জিডিপির (মোট দেশজ সম্পদ) কথা বিবেচনা করলেও একই অবস্থার প্রতিফলন ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের জিডিপির একটি তুলনামূলক চিত্র নিচে তুলে ধরা হলো -

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৬.২৯ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ৯.৩১ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৮.০৯ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ৬.৩৩ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ১২.৫১ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ৮.৭৭ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ১১.৩৪ বিলিয়ন ডলার। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ১০.১২ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ১৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার।

স্পষ্টত বঙ্গবন্ধুর আমলে বাংলাদেশের মোট দেশজ সম্পদ বা জিডিপি তিন গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায় অথচ তার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সম্পদ উধাও বা নাই হয়ে যায়। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতিকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু যদি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে উপরে বর্ণিত অতটা অর্থনৈতিক উন্নতি করতে পারেন, সেখানে তার মৃত্যুর পর মাত্র এক বছরের মধ্যে প্রায় পুরাপুরি পুনর্গঠিত জাতির এতবড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় কী করে ঘটল তা অনুসন্ধান করে দেখা দরকার। এটা যে স্বাধীনতা বিরোধীশক্তির দেশ স্বাধীন হওয়াটাকে ভুল প্রমাণের অপপ্রয়াস ও ষড়যন্ত্রের একটা অংশ তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭২-৭৫ এই তিন বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৮৪ ডলার (১৯৬%) আর পাকিস্তানের হয়েছিল মাত্র ১৬ ডলার (১০.৫%)। অপরপক্ষে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ১৯৭৫-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ঋণাত্মক বা ১৯৭৫ সালের তুলনায় ১০২ ডলার কম (-৩৬.৭%) আর পাকিস্তানের বৃদ্ধি পায় ৭৫ ডলার (৪৪.৬%)।

আরও তিন বছর পর ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় কিছুটা বেড়ে যায় কিন্তু তারপরও ঋণাত্মক বা ১৯৭৫ সালের তুলনায় ৩০ ডলার কম (-১০.৮%) হয়। অপরপক্ষে, এই ছয় বছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায় ১৮০ ডলার (১০৭%)। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ের এই ঋণাত্মক অবস্থান থেকে ধনাত্মক অবস্থানে উত্তরণ ঘটাতে বা ১৯৭৫ সালের মান ২৭৮ ডলার অতিক্রম করতে সময় লাগে সুদীর্ঘ ১৪ বছর (উল্লেখ্য, ১৯৮৯ সালে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছিল ২৮৬ ডলার)।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে চাই, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় স্বাধীনতার পর দুইবার পাকিস্তান এবং ভারতের তুলনায় বেশি হয়েছে। প্রথমবার পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সালে এবং ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের তুলনায় বেশি হয়েছে ১৯৭৪ সালে। আর দ্বিতীয়বার পাকিস্তানের তুলনায় বেশি হয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১৬ সালে আর পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া উভয় দেশের তুলনায় বেশি হয়েছে ২০২০ সালে।

এ সংক্রান্ত ব্যাপারে অর্থাৎ জননেত্রী শেখ হাসিনার আমলের অর্থনৈতিক সফলতা সম্পর্কে তুলে ধরা হবে পরের লেখায় (অদূর ভবিষ্যতে)। তবে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, স্বাধীনতার ঠিক পরে পাকিস্তানি এক রুপিতে পাওয়া যেত বাংলাদেশি ২ টাকা (শুনেছি এই কারণে অনেক পাকিস্তানি বাংলাদেশিদের উপহাস করে বলত দুই টাকার বাঙালি) আর বর্তমানে বাংলাদেশি এক টাকায় পাওয়া যায় পাকিস্তানি দুই রুপি।

প্রকৃতিতে দুই ধরনের আলোকিত বস্তু রয়েছে। এক ধরনের আলোকিত বস্তুর নিজস্ব আলো আছে যেমন সূর্য বা নক্ষত্র। আরেক ধরনের আলোকিত বস্তুর নিজস্ব কোনো আলো নেই, অন্য বস্তুর আলো আপতিত হলে আলোকিত দেখায়, যেমন চাঁদ এবং গ্রহ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো আলোকিত মানুষ। অন্যভাবে বলা যায় বাংলার আকাশে বঙ্গবন্ধু একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র স্বরূপ। কারণ প্রথমত: নক্ষত্রের যেমন নিজস্ব আলো আছে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর ছিল নিজস্ব আদর্শ আর সেই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে চাঁদের মতো আলোকিত হয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অসংখ্য মানুষ।

দ্বিতীয়ত: নক্ষত্র মৃত্যুঞ্জয়ী, যেমন ১৫০০ আলোকবর্ষ দূরের একটি তারার নাম রিগেল। সেই তারাটি যদি এই মূহর্তে মৃত্যুবরণ করে বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তাহলে পরবর্তী ১৫০০ বছর ধরে পৃথিবীবাসী সেটিকে জীবিত দেখতে পাবে। ঠিক একইভাবে বলা যায় বঙ্গবন্ধুও মৃত্যুঞ্জয়ী, অর্থাৎ এই পৃথিবীর বুকে যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে ততদিন বঙ্গবন্ধু বাঙালিদের হৃদয় আকাশে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো বিরাজমান থাকবেন।

তৃতীয়ত: গভীর সমুদ্রে দিশেহারা জাহাজের নাবিক যেমন ধ্রুবতারা দেখে দিক নির্ণয় করে থাকেন তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির মুক্তি এবং স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা দিয়েছিল। সেই ভাষণটি ২০১৭ সালে 'বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য'র অংশ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে। এই সম্মাননা বাঙালি জাতির জন্য অনেক গৌরব ও অহংকারের।

তার সেই ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। সেই ভাষণে তিনি এক পর্যায়ে বলেছেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' স্পষ্টত এটি স্বাধীনতার ঘোষণা তবে তিনি তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকরের কথা বলেননি। বরং যেদিন থেকে কার্যকর হবে তার কৌশলগত বর্ণনা দিয়েছেন এমনিভাবে, 'আর যদি একটি গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের উপর হত্যা করা হয়, তাহলে তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমাদের যাকিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।'

এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু চরম বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন কারণ তা না হলে অনুপযুক্ত সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করতেন। ফলে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো এবং স্বাধীনতা অর্জন সূদূর পরাহত হতো। যেমনটি ঘটেছিল নাইজেরিয়ার বায়াফ্রাতে। যা হোক, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর একই মাসের ২৫ তারিখ রাতে পাকিস্তানি বর্বর সেনাবহিনী গুলি করে অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে।

কাজেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বর্ণনা অনুসারে ২৫ মার্চ থেকে তার স্বাধীনতার ঘোষণা কার্যকর হওয়ার কথা ছিল যদি তিনি আর হুকুম দিতে না পারতেন। সেক্ষেত্রে আমাদের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে গণ্য হতো ২৫ মার্চ। কিন্তু তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বারা গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৫ মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ তারিখের প্রথম প্রহরে টেলিগ্রাম মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন- যা দেশে ও বিদেশে প্রচারিত হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের সংবিধানে ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস হিসেবে উল্লেখ আছে এবং আমরা তা পালন করে আসছি।

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি জাতির স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধ অধিকার একমাত্র ওই জাতির একজন নির্বাচিত অবিসংবাদিত নেতারই রয়েছে। বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ২৩ বছর অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রাম করে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয় লাভ করেন। কাজেই, স্পষ্টভাবে বলা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার ম্যন্ডেট একজন নির্বাচিত

অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে একমাত্র বঙ্গবন্ধুরই ছিল এবং তিনি তা যথাযথভাবে ও বিচক্ষণতার সঙ্গেই পালন করেছেন। এই কথাগুলো আমাদের পবিত্র সংবিধানের মুখবন্ধের স্বাধীনতা ঘোষণা অংশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। তাই তো অন্য কাউকে কোনোভাবে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে দাবি করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং সংবিধানবিরোধী।

সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, যখন বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয় তখন তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী হওয়ায় আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাই অবৈধ ও অকার্যকর হয়ে যায়। এ যেন প্রকারান্তরে আমরা এখনও পাকিস্তানের অংশই আছি দাবি করার সামিল।

লেখকঃ উপাচার্য, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী

সৌজন্যেঃ দৈনিক সমকাল

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত