জেলখানার চিঠি: পিতা-পুত্রের কথোপকথন

1055

Published on ডিসেম্বর 1, 2021
  • Details Image

বিচারপতি ওবায়দুল হাসান:

আজ দু’টি চিঠি নিয়ে কিছু কথা বলব। সহজ ভাবনার কথা। একটি চিঠি জেলখানা থেকে লেখা। অপরটি বাড়ি থেকে জেলখানায় এক কারাবন্দীর নিকট লেখা। না, এটা নাজিম হিকমতের সেই বিখ্যাত কবিতা নয় বা সে সম্পর্কিত কোন লেখাও নয়। বাস্তবে পিতা ও পুত্রের লেখা দু’টি চিঠিই আজকের উপজীব্য। একটি চিঠি ছেলে লিখেছিলেন বাবার কাছে। এর চার বছর পরে ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবার লেখা আরেকটি চিঠি। উল্লেখ্য, চিঠি দু’টি কিন্তু একটি অপরটির প্রতিউত্তর নয়।

ভারতবর্ষের বহু নেতা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে জেলে কাটিয়েছেন অনেক বছর। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু অনেকদিন কারাগারে বন্দী জীবন কাটিয়েছেন। জেলখানা থেকে তার লেখা অনেক চিঠি পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তার চিঠিতে তখনকার সমাজচিত্র, জেলাখানার অভ্যন্তরের অবস্থা ও আন্দোলন সংগ্রামের জন্য কিভাবে প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, সে চিত্র পাওয়া যায়। তার লেখা চিঠিগুলোর প্রাপকদের মধ্যে সম্ভবত তার বড় ভাই শরৎ চন্দ্র বসু, বার-এ্যাট-ল এর নাম এক নম্বরে থাকবে। পন্ডিত জওহরলাল নেহরু চিঠি লিখেছেন জেলখানা থেকে তার কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। সেগুলোতে প্রকৃতি, মানব ইতিহাস, পৃথিবীর আদিকাল সম্পর্কিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ব্রিটিশ স্টেটসম্যান চেস্টারফিল্ড তার পুত্রের কাছে অনেক উপদেশমূলক পত্র লিখেছেন। সেগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ সব পড়লে সমাজ জীবনে চলতে-ফিরতে কি গ্রহণীয় আর কি বর্জনীয়, তার একটা দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়। এ সব চিঠি কেবল নিতান্ত চিঠি ছিল না। শুভ ভাবনা, দর্শন ও চেতনার চাদরে আবৃত ছিল এ সব চিঠি।

ওপরে যাদের চিঠির কথা উল্লেখ করা হয়েছে তাদের সবার তুলনায় আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় পিছিয়ে থাকা একজন মানুষ ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কালের পরিক্রমা ও বিবর্তনে সংগ্রাম, আন্দোলন, ত্যাগ, তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে এই মানুষটিই একদিন হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু। তিনি স্থান করে নেন আপামর জনতার মণিকোঠায়। দেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট হয়ে ওঠেন একজন অবিসংবাদিত নেতা আর প্রতিষ্ঠিত হন বাঙালী জাতির পিতা হিসেবে। নির্মোহ, নিরহংকারী, নিষ্কলুষ চরিত্রের সাদা মনের বিরোচিত এই মানুষটি তার জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কাটিয়েছিলেন কারান্তরালে। সেই কারানিবাস থেকে পিতা শেখ লুৎফর রহমানকে লেখা তার একটি চিঠি আজ এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এই চিঠির মর্মার্থ থেকে তার সম্পর্কে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক অবস্থা ও তার প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ সম্পর্কে জানা যায়। জানা যায় প্রিয় স্বজনদের প্রতি তার ভালবাসা ও উদ্বিগ্নতার কথা।

১৯৫৮ সালের ১২ নবেম্বর ঢাকা জেল থেকে রাজনৈতিক বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান তার বাবাকে লিখেছেন-

আব্বা,

আমার ভক্তিপূর্ণ ছালাম গ্রহণ করবেন ও মাকে দিবেন। মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল। কারণ এবার তার সামনেই আমাকে গ্রেফতার করেছিল। দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামিও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই। আপনি জানেন, আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ি যেতে বলে দিতাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে।

আমাকে আবার রাজবন্দী করেছে, দরকার ছিল না। কারণ রাজনীতি আর নাই এবং রাজনীতি আর করব না। সরকার অনুমতি দিলেও আর করব না।

যে দেশের মানুষ বিশ্বাস করতে পারে যে, আমি ঘুষ খেতে পারি সে দেশে কোন কাজই করা উচিত না। এ দেশে ত্যাগ ও সাধনার কোন দামই নাই। যদি কোনদিন জেল হতে বের হতে পারি তবে কোন কিছু একটা করে ছেলেমেয়ে ও আপনাদের নিয়ে ভালভাবে সংসার করব। নিজেও কষ্ট করেছি, আপনাদেরও দিয়েছি। বাড়ির সকলকে আমার ছালাম দিবেন, দোয়া করতে বলবেন। আপনার ও মায়ের শরীরের প্রতি যত্ন নিবেন। চিন্তা করে মন খারাপ করবেন না। মাকে কাঁদতে নিষেধ করবেন। আমি ভাল আছি।

আপনার স্নেহের

মুজিব

বি.দ্র: গোপালগঞ্জের বাসাটি ভাড়া দিয়া দেবেন, বাসার আর দরকার হবে না।

মুজিব।

(সূত্র : বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠা : ৯৭)

এটি সহজ সত্য কথায় লেখা একজন রাজবন্দীর একটি অসাধারণ চিঠি, যার মধ্যে ফুটে উঠেছে মহান সৃষ্টিকর্তার ওপর অগাধ আস্থা। সেই সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অত্যাচার-অনাচার ও বৈষম্যের ধরন। একজন সাবেক মন্ত্রীর আর্থিক অবস্থা, অবুঝ মানুষের ভ্রান্ত চিন্তার কারণে মন খারাপ করার কথাও সামনে এসেছে এই চিঠিতে।

অকপট বচনে লেখা এই চিঠির শুরুতেই পিতামাতাকে সালাম জানিয়ে বন্দী মুজিব মায়ের কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন এই বলে যে, ‘মা এবার খুব কষ্ট পেয়েছিল, কারণ তার সামনেই আমাকে গ্রেফতার করেছিল’। তারপরই আবার তিনি তার দৃঢ়তা প্রকাশ করে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার গভীর আস্থা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন- ‘দোয়া করবেন মিথ্যা মামলায় আমার কিছুই করতে পারবে না। আমাকে ডাকাতি মামলার আসামিও একবার করেছিল। আল্লাহ আছে, সত্যের জয় হবেই।’

১৯৫৪ ও ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী ছিলেন- এটা সর্বজনবিদিত। ‘১৯৫৮ সালে বন্দীদশায় থেকে শেখ মুজিব বাবাকে লিখেছেন, ‘আপনি জানেন আমার কিছুই নাই। দয়া করে ছেলেমেয়েদের দিকে খেয়াল রাখবেন। বাড়ী যেতে বলে দিলাম। কিন্তু ওদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে যাবে।’ ১৯৫৮ সালে শেখ মুজিব চার সন্তানের জনক, সাবেক মন্ত্রী, তথাপি আর্থিক অনটন তাকে পিছু ছাড়েনি। সন্তানদের প্রতি উদ্বিগ্নতা সত্ত্বেও একজন সৎ রাজনীতিবিদের প্রতিচ্ছবি শেখ মুজিব। চিঠিতে লেখা তার এই কথাটিতে সেটিই মূর্ত হয়েছে। পিতার আর্থিক সামর্থ্য ছিল। তাই পিতার কাছেই চাওয়া। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার যাতে ক্ষতি না হয়, সে জন্যই শুধু তাদের ঢাকায় থাকা। মন্ত্রীর বাসভবন থেকে ’৫৮ এর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি বের হয়ে যেতে হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের। নিকট আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব ছাড়া তেমন কেউ তখন খোঁজ নেয়নি তাদের। শেখ মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান বউমা ও নাতি-নাতনিদের খোঁজ নিতেন, প্রয়োজনীয় খরচাদি পাঠাতেন। এখনও অনেক সাবেক মন্ত্রী আছেন। অনেকে ভবিষ্যতে ‘সাবেক’ হবেন। তাদেরকে বিনীতভাবে অনুরোধ করব, ’৫৮ সালে বন্দীদশার একজন সাবেক মন্ত্রীর তার বাবাকে লেখা এই চিঠিটি পড়তে। চিঠিতে প্রতিফলিত সত্যগুলো অনুধাবন করতে।

‘৫৮ সালে বন্দী হয়ে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ১৯৬২, ১৯৬৪ এবং ১৯৬৬ সালে তিনি বারবার কারারুদ্ধ হয়েছেন। বাবার নিকট লেখা চিঠিতে ক্ষোভে, অভিমানে লিখেছিলেন যে, তিনি আর রাজনীতি করবেন না। কিন্তু এটি কি সম্ভব ছিল বাংলার মানুষের আপামর নেতা শেখ মুজিবের পক্ষে ছিল না। আর তাই তিনি ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবি পেশ করে পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। আর এই অপরাধে আবারও তাকে গ্রেফতার করা হলো। তার ঠিকানা হলো কারান্তরালে। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। মানুষেরও ধৈর্য্যরে সীমা থাকে। আর সেই সীমা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন মানুষ ফুঁসে ওঠে। সারা বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়ে, আওয়াজ উঠল- ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। ‘জেলের তালা ভাঙ্গব, মুজিব ভাইকে আনব’।

১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুয়ারি সবার প্রিয় মুজিব ভাই মুক্ত মানুষ হিসেবে আবার তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে ফিরে আসেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ মুজিব ভাইকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ‘বঙ্গবন্ধুু’ উপাধিতে ভূষিত করে। তখন থেকে তিনি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা সকলের বন্ধু, ‘বঙ্গবন্ধু।

শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু হওয়া পর্যন্ত বাংলার এই অবিসংবাদিত নেতাকে বহুবার জেলে যেতে হয়েছে। বাবার নিকট বা রাজনৈতিক অনেক নেতাকর্মীর নিকট তিনি জেলখানা থেকে চিঠি লিখেছেন। তার কাছেও অনেকে চিঠি পাঠিয়েছেন সে সময়। এ রকম একটি চিঠি হলো বঙ্গবন্ধুকে তার বাবার লেখা ৩১.৩.১৯৬২ তারিখের একটি চিঠি। তিনি লিখেছেন-

Tungipara

৩১.৩.৬২

বাবা খোকা,

শুরুতেই দোয়া জানিবা। তোমার ২৯/৪/৬২ তারিখের (তারিখটি সম্ভবত ভুল ছাপা হয়) চিঠি একমাস পরে পাইলাম। ‘ঢাকা হইতে ছোট্ট বউ চিঠি লিখিয়াছিল যে, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে এবং কয়েকদিন পরেই সকলকে লইয়া আমাদের দেখিতে আসিবে’। কিন্তু আজ ২০/২৫ দিন হইয়াছে আর কোনও সংবাদ পাইতেছি না। ‘খোদা তায়ালা বলিয়াছেন তাহার বান্দাকে যে নির্যাতন করিবে আমি তাহাকে নির্যাতন করিব।’ ইহা পূর্বাপর ঘটনা হইতে সকলেই জানিতেছে এবং দুনিয়ার ইতিহাসও তাহা সাক্ষ্য দিতেছে। বেশি দিন হয় নাই তুমি নিজেও দেখিতে পাইয়াছ। তোমাকে আটক করিয়া রাখার অর্থ হইতেছে আমাদের মতন বৃদ্ধ পিতামাতা, নাবালক ছেলেমেয়েদের এবং স্ত্রীর উপর নানারূপ অত্যাচার করা। আমরা উপায়হীন, সহ্য করিতে বাধ্য কিন্তু খোদাতায়ালা নিশ্চয়ই সহ্য করিবেন না। চিন্তা করিবা না সব কিছু খোদাতায়ালার উপর নির্ভর। তিনি যাহা করেন মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন। সত্যের জয় হবেই। নানারূপ মিথ্যা মোকদ্দমা চাপাইয়া তাহাতে কোনও ফল না পাইয়া তোমার সততার ছাফাই পাইয়াছে তাহা সত্তে¡ও তুমি কিছু না করিলে তোমাকে কেন যে আটকাইয়া রাখিতে হইবে তাহাই বুঝিতে পারিতেছি না। শুনিয়াছিলাম তোমাকেই সর্বাগ্রে মুক্তি দিবে কিন্তু এখনও তাহার কোনও সম্ভাবনা দেখিতেছি না। দেশবাসী প্রায় সকলেই সরকারের গোচরে সকল প্রকার রাজবন্দীদের এবং ছাত্রদের মুক্তির প্রার্থনা দিয়াছে। মনে হয় শীঘ্রই তোমাদের মুক্তি দিবে...। ঢাকার সকলে ভাল আছে। মীরার মার হাঁফানী উঠিয়াছিল, সেটা গোপালগঞ্জে শুনিলাম যে একটু ভাল হইয়াছে। আমরা বাড়ীর সকলেই ভাল আছি। তোমার মেজ বুজির শরীর খুবই খারাপ। সব সময় দোয়া করিতেছি এবং খোদার দরগায় প্রার্থনা যে তিনি তোমাদের মঙ্গল করুক। ৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়।

তোমার

আব্বা

Sheikh Mujibur Rahman

Security Prisoner

Central Jail

Dacca.

(সূত্রঃ বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত চিঠিপত্র পৃষ্ঠা : ২১৭)

কারাগারে আটক পুত্র শেখ মুজিবকে লেখা এই চিঠির প্রথমাংশে পুত্রকে দেখার আশায় পথপানে চেয়ে থাকা এক অশিতিপর বৃদ্ধের অনুচ্চারিত কান্নার কথাই ফুটে উঠেছে। কারাবন্দী পুত্রকে লেখা পত্রে পরের কথাগুলো থেকে বঙ্গবন্ধুর পিতার আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা ও আস্থার প্রকাশ ঘটেছে। বান্দার ওপর যে অন্যায় জুলুম খোদা তায়ালা সহ্য করেন না- এটাও সম্নণ করিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ বাবা তার আদরের সন্তান খোকাকে।

পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টোর মধ্যে একটি বাক্যের ছিল সমউপস্থিতি। সেটি হলো- ‘সত্যের জয় হবেই’। পিতা তার কারাবন্দী পুত্রকে লেখা চিঠিতে ও পিতাকে লেখা কারাবন্দী পুত্রের চিঠিতে এই তিনটি শব্দের অভিন্ন উচ্চকিত বাক্যটি নিঃসন্দেহে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের উভয়েরই গভীর আস্থার কথাটি উঠে এসেছে। সাধারণত ধর্মপ্রাণ প্রত্যেকটি মানুষই যার যার ধর্ম বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার পর আস্থা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারে ধর্মচর্চা তাদের পরিবারের একটি ঐতিহ্য। কিন্তু এই ধর্মপ্রাণ পরিবারটি একই সঙ্গে ছিল অসাম্প্রদায়িক। এই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা বঙ্গবন্ধু নিজ জীবনে করেছেন এবং তিনি তার সন্তানদেরকেও এই শিক্ষা দিয়েছেন। সম্ভবত বঙ্গবন্ধু উত্তরাধিকার সূত্রে তার পিতার কাছ থেকেই একজন অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষ হওয়ার শিক্ষাটি পেয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠির শেষাংশে তার পিতা পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও আত্মীয়-স্বজনের খবরাখবর জানিয়েছেন পুত্রকে। এ থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু তার কাছের দূরের আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর রাখতেন বা তাদের খবরাখবর জানতে চাইতেন। এটি ছিল তার যাপিত ব্যক্তি জীবনের এক অনিবার্য ধরন। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি তারা সবাই আত্মীয়-পরিজন বেষ্টিত অবস্থায় থাকতে পছন্দ করি। সকলকে নিয়েই শান্তি ও সুখের নীড় গড়তে চাই। বঙ্গবন্ধুর পিতার চিঠিটি পড়ে মনে হয় বঙ্গবন্ধু যেমন দেশবাসীর জন্য সারা জীবন চিন্তা করেছেন, ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্যদের প্রতিও ছিল তার খেয়াল ও সদা উদ্বিগ্নতা। তিনি কখনও পরিবারের স্বজনদের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন না।

বঙ্গবন্ধুর পিতা তার চিঠির শেষ লাইনে লিখেছেন- ‘৮০ বৎসর বয়সের বৃদ্ধ ব্যক্তির পক্ষে এমন লেখা খুব কঠিন। তাই খুব ধীরে লিখিতে হয় এবং লিখিতে একটু দেরি হয়’। হায়রে মমতাময় পিতা! কত কষ্টই না বুকে ধারণ করে এই চিঠিটা তিনি কারাবন্দী পুত্রকে লিখেছিলেন। বঙ্গন্ধুর পিতামাতা তাদের জীবনের দীর্ঘ সময় তাদের প্রিয় সন্তান খোকাকে কাছে পাননি। কারণ তিনি জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন মানুষের জন্য রাজনীতি করতে গিয়ে। আর এই অপরাধে তাকে বরণ করতে হয়েছে দীর্ঘ কারাবাস। সর্বশেষ, ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ থেকে ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। তার ফিরে আসার অনিশ্চয়তা তখন যেমন সারা জাতিকে ভাবিয়ে তুলেছিল, ঠিক তেমনি পরিবারের সদস্য বিশেষ করে পিতামাতা, স্ত্রী-সন্তানদেরকেও তখন দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে এক কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। দীর্ঘ সাড়ে নয় মাস সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্নভাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবার এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়েছিলেন। অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির পিতা স্বদেশে ফিরে এলেন তার প্রিয় দেশবাসীর কাছে। প্রিয় স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে। ফিরে এলেন পিতামাতা ও স্ত্রী-সন্তানদের কাছে।

সারা পৃথিবীর মানুষ অগাধ বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মাথায় মুক্ত স্বাধীন বাংলার স্থপতি অবিসংবাদিত নেতাকে এ দেশেরই কিছু কুলাঙ্গার সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। ভাগ্যের জোরে দেশে না থাকার সুবাদে বেঁচে গেছেন জাতির পিতার দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা। তারা হয়েছেন পিতৃ-মাতৃহীন। বাঙালী জাতি হারিয়েছে তাদের নেতাকে, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী তাদের জাতির পিতাকে।

যে দু’টি চিঠি নিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম সেই দু’টি চিঠিরই একটি অভিন্ন বাক্য ‘সত্যের জয় হবেই।’ পিতা ও পুত্রের চিঠি দু’টিতে যে হৃদয় নিঃসৃত সত্য বচনগুলো মূর্ত হয়েছে, সেগুলোর চর্চা ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় জীবনকে সমৃদ্ধ করবে। শেখাবে অনেক কিছু। চিঠি দু’টিতে ব্যক্ত পিতা ও পুত্রের ধারণা এবং দর্শন আমরাও পোষণ করি। বাঙালী জাতি জন্মজন্মান্তরে এই ধারণাই পোষণ করবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখিয়ে গেছেন। সত্যকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে শিখিয়েছেন। কারণ, সত্যের নেই কোন ক্ষয়, নেই কোন লয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে তার দুই কন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করি।

লেখক : বিচারপতি, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপীল বিভাগ

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকন্ঠ

(মতামত লেখকের নিজস্ব। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত