একাত্তর-পচাত্তর-চব্বিশ একই সুতোয় গাঁথা

2334

Published on আগস্ট 12, 2025
  • Details Image

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। ভয়ংকর কালো একটি দিন। এই দিন ইতিহাসে লেখা হয়েছিল নিষ্ঠুরতার সবচেয়ে কালো এক অধ্যায়। অতি ভয়ংকর সেই নিষ্ঠুরতায় হতবাক হয়েছিল দেশ ও জাতি। বেদনার্ত হয়েছিল পুরো বিশ্ব। এই দিনে বাঙালি জাতির প্রিয় নেতা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের সর্বস্ব উজার করে দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির কল্যাণে। বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তিনি ছিলেন অকুতোভয়। বিনিময়ে সহ্য করতে হয়েছে জেল-জুলুম-নির্যাতন। ফাঁসির মঞ্চে তোলারও আয়োজন হয়েছিল। বাঙালির দুর্বার আন্দোলনের কারণে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন। হার না মানা এই বীর অবশেষে সফল হয়েছেন। দেশকে হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করেছেন। বাঙালি জাতি পেয়েছে মুক্ত স্বাধীন দেশ। পেয়েছে গৌরবের পতাকা। আর তাই তো তিনি বিবিসির জরিপে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশের। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বে দেশ যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে, তখনই শুরু হয় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি সুযোগ খুঁজতে থাকে ছোবল দেওয়ার জন্য। আর সেই ষড়যন্ত্রের বলি হতে হয় বাঙালির প্রাণপ্রিয় এই নেতাকে। বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর একটি অংশ রাতের আঁধারে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে প্রিয় নেতার বাড়িটি ঘিরে ফেলে। ভোর হওয়ার আগেই ঘটিয়ে ফেলে ইতিহাসের বর্বরতম, নিষ্ঠুরতম এক হত্যাযজ্ঞ। রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশু সন্তানটিও।
তাই ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জন্য এক বেদনার দিন, কান্নার দিন। কবি নির্মলেন্দু গুণের মতোই বলতে হয়, ‘এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি, কাঁদো।’ পঞ্চাশ বছর পরও এই দিনটি একইভাবে বেদনায় নীল করে, হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়, চোখ ফেটে বেরিয়ে আসে জলের ধারা। কোনোর বাঙালির হৃদয়ের চোখ কি ভুলে যেতে পারে সেই নির্মম নিষ্ঠুর দৃশ্য! জাতির জনকের রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে আছে সিড়ির ওপর। ঘরময় ছড়িয়ে আছে তাল তাল রক্ত, আর জাতির পিতার আপনজনদের প্রাণহীন দেহগুলো। কি দোষ ছিল তাঁদের। দোষ একটাই, তাঁরা দেশের মঙ্গল চেয়েছিলেন, দেশের মানুষের কল্যাণ চেয়েছিলেন। আর সেটাই সহ্য হয়নি মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ও তাদের প্রভুদের।

এখনও পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাই স্বাধীনতা-উত্তরকালের দিনগুলো। সদ্য স্বাধীন দেশে আমরা তখন হাওয়ায় ভেসে চলছি যেন। চারদিকে মুক্তির আনন্দ। নতুন করে দেশ গড়ে তোলা হচ্ছে। আমি তখন ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র হলেও দিন কাটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অফিসে। কেন্দ্রীয় নেতারা সবাই চেনেন, জানেন। স্নেহ করেন। চোখ বন্ধ করলে এখনও যেন দেখতে পাই ফেলে আসা সেই দিনগুলো। স্পষ্ট মনে আছে সব স্মৃতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থন করে বহিষ্কার হওয়ার পর এই প্রথম তিনি যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। জাতির জনককে সর্বোচ্চ সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাতে আমাদের প্রস্তুতির অন্ত নেই। দিনরাত কাজ আর কাজ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ, তো কিছুক্ষণ পরই মিরপুর রোডে ছাত্রলীগের কার্যালয়ে কাজ। রাতে কোনো মতে কিছু সময়ের একটু ঘুম। সকাল থেকেই আবার কাজের তোড়জোড়। কেমন মঞ্চ হবে, কে কোথায় কোথায় কোন্ দায়িত্ব পালন করবে। রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হবে। নানা প্রস্তুতি। ১৪ আগস্টের সারাদিন কেটেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর ও মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে।

মনে পড়ে সন্ধ্যার পর থেকে কয়েকজনের সঙ্গে আমিও ছিলাম ৩০ মিরপুর রোডের মহানগর ছাত্রলীগের অফিসে। ছাত্রলীগ অফিসের কাছাকাছি ঢাকা কলেজের ঠিক উল্টো দিকে ছিল চিটাগাং রেস্টুরেন্ট। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে আমরা তিনজন (ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন ও আমি) আমাদের পথ ধরি। বলাকা সিনেমা হলের সামনে গিয়ে একটা রিক্সা পেয়ে যাই।

চেপে বসি ঐ রিক্সায়। নিউমার্কেট, নিলক্ষেত হয়ে আমাদের রিক্সা ঢোকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। আমাদের রিক্সা এগুতে থাকে। টিএসসি পেরিয়ে বাংলা একাডেমির সামনে দিয়ে আমরা গেলাম তোপখানা রোডে (জাতীয় প্রেস ক্লাবের ঠিক উল্টো দিকে) জাতীয় যুবলীগের অফিসে। রাত ১২টা সাড়ে ১২টায় গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে। ৩১৭ নম্বর রুমের বাসিন্দা ওবায়দুল হক বাবুল ভাইয়ের কাছে। ঐ রুমেই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভেঙ্গে গেল কাকভোরে, দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে। দরজা খুলতেই দেখা গেল সেখানে উপস্থিত হলের ক্যান্টিন ম্যানেজার। ভদ্রলোক জানালেন, তিনি রেডিওতে শুনেছেন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। খবর শুনে আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। কী করব ভেবে পাচ্ছি না। রেডিও অন করতেই খবরটি শুনতে পাই আমরা। হতভম্ব হয়ে যাই। চোখের পানি থামছিল না। তাড়াতাড়ি হল থেকে বেরিয়ে পড়ি। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তল্লাশি হতে পারে। হল থেকে বেরিয়ে চলে যাই আলুবাজারে।

শহরজুড়ে ট্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাজোয়া যানে সেনা সদস্যরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। এক ভয়ের, আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে বেরিয়ে চলে গেলাম রথখোলা মোড়ে। জগন্নাথ কলেজের সাইদুর রহমান (এস আর হল) হলে আমি থাকি তখন। গোটাকয়েক কাপড় নিয়ে সোজা গেলাম যাত্রাবাড়ীর দিকে। রাস্তায় কোন মানুষ নেই। সাধারণ যানবাহন নেই। একটা দুটো রিক্সা চলে। আমরা তিনজন হাঁটছি। কোথায় গিয়ে থামব জানি না। একসময় গিয়ে পৌঁছলাম তোফাজ্জল ভাইয়ের পোস্তগোলা বটতলার বাড়িতে। গত রাতের পর থেকে পেটে কিছু পড়েনি। তার ওপর দুশ্চিন্তা।

আমরা পোস্তগোলা থেকে বেরিয়ে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জে একটা প্রেসে এসে আশ্রয় নিলাম। বাঁশের চাটাইয়ের বেড়ার ঘর। ওপরে টিনের ছাউনি। সে আমলের হ্যান্ড প্রেস। চারদিকে কালি আর কেরোসিন তেলের গন্ধ। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হলো। রাত নেমে এল। শারীরিক, মানসিক কোনো শক্তিই অবশিষ্ট নেই। মাঝেমধ্যে রেডিওতে খবর শুনছি। হতাশায় ভরে যাচ্ছে মন। সন্ধ্যার পর থেকে বিদ্যুত নেই। থাকলেও কোনো লাভ ছিল না। যে ১৫ আগস্ট সকাল থেকে আনন্দে মেতে থাকার কথা ছিল আমাদের। জাতির জনককে সংবর্ধনা জানানোর কৃতিত্বের অংশীদার হওয়ার কথা ছিল। তার কিছুই হলো না। রাতের অন্ধকারে আমরা তিনটি প্রাণী দয়াগঞ্জের সেই বাঁশের চাটাইয়ের বেড়া দেয়া প্রেসে মুখোমুখি বসে থাকলাম। আমাদের মুখে কোন কথা নেই। অন্ধকার আমাদের শরীর ছুঁয়ে আছে। সেসব স্মৃতি এখনো জ্বল জ্বল করে।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনাটি ছিল সুদূরপ্রসারী। শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা নয়, তাঁর আদর্শকেও নির্বাসনে পাঠানোর গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ঘাতকের বুলেট সেদিন ধানমন্ডির ঐ বাড়িতে শেখ পরিবারের কাউকে রেহাই দেয়নি। রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেল কিংবা পুত্রবধূরাও। এই জঘন্য হত্যাকান্ডের ঘটনাটি যে ঘাতকচক্রের পূর্ব পরিকল্পনা, তা স্পষ্ট হয় হত্যা পরবর্তী কর্মকান্ড থেকেই। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের সদস্য ও ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে হত্যাকারীদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত করেছিল, পুরস্কৃত করেছিল। খুনিদের রক্ষা করার জন্য দেশের সংবিধানেও হাত দেওয়া হয়েছিল। এই পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিচার রহিত করা হয়েছিল ইনডেমনিটি আইন পাস করার মাধ্যমে। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ঘটনা শুধু ব্যক্তি মুজিবকে হত্যার প্রয়াস ছিল না, ছিল জাতির স্বাধীনতার শক্তিকে হত্যার অপচেষ্টা।

সেই অপচেষ্টা এখনো বিদ্যমান। একাত্তর ও পচাত্তরের ঘাতকেরা এখন পুরো মাত্রায় সক্রিয়। চব্বিশও তাদের সেই ষড়যন্ত্র প্রত্যক্ষ করেছে। একাত্তর, পঁচাত্তর, চব্বিশ যে একই সুতোয় গাঁথা। চব্বিশেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাহাত্তরের সংবিধান- সবই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য। তাদের সেই আক্রোশ দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর ভাষ্কর্য ভাঙার মধ্যে। তারা শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট করেই ক্ষান্ত হয়নি, বুলডোজার দিয়ে সেই বাড়ি গুড়িয়ে দিয়েছে। এখন তাদের আক্রোশের লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর সমাধি। গোপালগঞ্জে গিয়েছিল সেই লক্ষ্যেই। কিন্তু জনতার প্রতিরোধের মুখে তাদের ফিরে আসতে হয়।
ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে খুন করে তারা একটি আদর্শকে খুন করতে চেয়েছিল। কিন্তু এ দেশে তা সম্ভব হয়নি, কখনো হবেও না। আজ বঙ্গবন্ধু আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। আরো বেশি জীবন্ত। আরো বেশি অনুপ্রেরণার উৎস। জাতি আজ আবারও এক দুঃসময় পার করছে। তাই আমাদের আবারও শপথ নিতে হবে, সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুজিবের আদর্শকে এগিয়ে নিতে হবে। একাত্তরের পরাজিত শক্তিকে রুখে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সকল অর্জনকে রক্ষা করতে হবে এবং প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, বাঙালির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে।

আজ ১৫ আগস্ট পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করি সেই মহান বাঙালিকে, যাঁর পরিচয়ে বাঙালি পরিচিত। বিশ্বজুড়ে তিনিই তো বাঙালির পরিচয়সূত্র। পঞ্চাশতম শাহাদাত বার্ষিকীতে জাতির জনকের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: এম নজরুল ইসলাম। সর্ব ইউরোপিয়ান আওয়ামী লীগের সভাপতি।

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত