পশ্চিমা সেক্যুলারিজম বনাম বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা

2166

Published on মার্চ 14, 2021
  • Details Image

সুফি ফারুক ইবনে আবুবকর:

ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি ইংরেজী সেক্যুলারিজম (Secularism) এর বাংলা অনুবাদ। আমাদের এদিকে তথা ভারতবর্ষে অতীত সমাজ কাঠামো এমনিতেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। তাই এই ধারণাটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হয়নি। এ জন্যই হয়ত এই ধারণাটিকে সংজ্ঞায়িত করার জন্য আমাদের নিজস্ব কোন শব্দ তৈরি হয়নি। ধারণাটি প্রকাশের জন্য আধুনিককালে এসে ইংরেজী অনুবাদ থেকেই একটি কাঠামোবদ্ধ শব্দ আমরা ব্যবহার করছি। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে অনেক আগেও এর প্রয়োজন হয়েছে। খুব যৌক্তিক কারণে প্রয়োজন হয়েছে। কারণ ক্ষমতা ও ধর্মের দ্বন্দ্বে তাদের মধ্যে অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, অন্যায় হয়েছে, অবিচার হয়েছে। তাই তারা অতীত ধর্মযুদ্ধ, রাষ্ট্র ও ধর্ম-প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দ্বন্দ্ব ইত্যাদির অভিজ্ঞতার বিষয়কে বিবেচনায় নিয়ে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে সম্পূূর্ণভাবে আলাদা করার থিওরির নাম দিয়েছে ‘Secularism’, ইংরেজীতে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘the belief that religion should not be involved in the organization of society, education, etc’. Secularism’ টার্মটিকে পশ্চিমা বিশ্বের ডিকশনারিগুলোতে এভাবেই লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দুরভিসন্ধি নিয়ে সেই শব্দগুলোর অনুবাদ করতে চাইলে তাকে ‘ধর্মহীনতা’ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়, যদিও তার প্রকৃত ব্যাখ্যা ধর্মহীনতা নয়।

কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষী ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী পশ্চিমা ডিকশনারির সেই অর্থকে ‘ধর্মহীনতা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের বার বার বিভ্রান্ত করেছে। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম একটি মূলনীতিকে আক্রমণ করেছে। সেই অক্রমণের ধারাবারিকতায় তারা স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী এবং প্রথম সংবিধান প্রণেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামী লীগকেও বার বার ধর্মবিরোধী বলে কুৎসা রটিয়েছে। সেই ষড়যন্ত্র এবং আক্রমণ আজও চলমান। যার দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের প্রত্যেকের এই বিষয় নিয়ে স্পষ্ট ধারণা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত ষড়যন্ত্রকারীরা মানুষের ধর্মানুভূতির সুযোগ নিয়ে ষড়যন্ত্র করতেই থাকবে।

তারা জানে অথচ স্বীকার করে না যে বঙ্গবন্ধু পশ্চিমা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মতাদর্শকে গ্রহণ করেননি। তিনি আমাদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার একটি নতুন অর্থ ও রূপরেখা তৈরি করেছিলেন, যা আজ শুধু আমাদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য সমানভাবে কার্যকর। সম্প্রতি নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার রূপরেখা শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের জন্যই নয়, বিশ্বের সব দেশের জন্য শিক্ষণীয়, প্রয়োজনীয় এবং এখনকার প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে জরুরী। কারণ বঙ্গবন্ধু যে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন, সেটি তো পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা নয়ই বরং উল্টো।’ পশ্চিমা বিশ্ব ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে রাষ্ট্র বা সমাজকে ধর্মবিষয়ক যে কোন বিষয়কে প্রশ্রয় না দিতে এবং নিরুৎসাহিত করতে চেয়েছে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ ও ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, কোন মানুষ যেন তার ধর্ম বিশ্বাসের কারণে রাষ্ট্রের কাছে কোন অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়। কেউ ধর্মবিশ্বাসের কারণে যেন অনিরাপত্তা বোধ না করেন। সার্বিকভাবে প্রতিজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি (সেটি যে ধর্মের বা যে বিশ্বাসেরই হোক) নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে যেন তার ধর্ম পূর্ণ উদ্যমে পালন করতে পারেন। সেখান রাষ্ট্র তো বাধা দেবেই না, বরং প্রত্যেকের সেই অধিকার চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে।

একটি অপপ্রচার করা হয় যে, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা স্বাধীনতার পূর্বে কোথাও বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামী লীগ বলেনি। স্বাধীন হওয়ার পরে অন্য দেশের পরামর্শে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে দেশের মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। এই অপপ্রচারের পেছনেও একই গোষ্ঠী জড়িত এবং দুরভিসন্ধি একই। অথচ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু আগে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম কথাটি বাদ দিয়েছিলেন সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে। এমনকি ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ করার সময়ও তিনি জানতেন ‘মুসলিম’ শব্দটি সময়মতো তিনি তুলে দেবেন। এ বিষয়ে একজন সহকর্মীর প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এখনও সময় আসেনি, সময়মতো সর্বজনীন করা হবে।’ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও প্রচার-প্রচারণা অসাম্প্রদায়িকতার আলোকে আলোকিত।

অসাম্প্রদায়িকতার চেতনা বঙ্গবন্ধুর কাছে কোনভাবেই নতুন কোন অনুভব নয়। তিনি এই আলোকে অনেক আগেই আলোকিত। বরং তার দীর্ঘ লেখাপড়া, চিন্তা ভাবনা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সেই বোধ আরও শাণিত হয়েছিল, যেখান থেকে তিনি একটি নতুন রূপরেখা করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তিনি ইতিহাসের একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন। পাশাপাশি তিনি একাগ্রতার সঙ্গে বাংলার মানুষের অন্তর অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি জানতেন, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় দ্বন্দ্ব ও ঘৃণা এই ভূখণ্ডে মূলত আমদানি করেছিল পশ্চিমারা। সেই ঘৃণাকে তারা লালন-পালন করে কুৎসিততম রূপ দিয়েছে এখানে। সাম্প্রদায়িকতাকে তারা শাসন এবং শোষণের হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করেছে। এরপর ছেড়ে যাওয়ার সময় ধর্মের ভিত্তিতে, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে, দেশকে ভাগ করে গেছে। বঙ্গবন্ধু দেখলেন, নতুন গঠিত পাকিস্তানেও ইসলামের আদর্শ বাস্তবায়নের বদলে ইসলামকে ব্যবহার করে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা ও শোষণ করা হচ্ছে। একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বুঝতে পারেন মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টিকে এ্যাড্রেস করতেই হবে। একদিকে যেমন ধর্মের নামে প্রতারণা, শাসন-শোষণ; অন্যদিকে ইতিহাস, অর্থনীতি ও অন্যান্য কারণে এই উপমহাদেশের মানুষের ওপর ধর্মের প্রভাব প্রবল। তিনি এসব বিষয় নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা করেই ধর্মনিরপেক্ষতার নতুন রূপরেখা প্রবর্তন করেছিলেন। যার আলোকেই তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের এবং স্বাধীনতার পরে নতুন সংবিধান প্রণয়নে।

কুচক্রীরা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে আরেকটি অপপ্রচার করে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা শুধু অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের জন্য দরকার। মুসলিমদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার কোন প্রয়োজন নেই। এটিও এক ধরনের ষড়যন্ত্র এবং ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের একটি দেশে, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন অমুসলিমদের চেয়ে মুসলিমদেরই বেশি। মুসলিমদের মধ্যে বিভিন্ন দল-উপদলের বিভক্তি খুব কাছে থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধু। এক ফেরকার বিপক্ষে অন্য-ফেরকার অসহিষ্ণুতা, হিংস্র ফতোয়াসহ শিয়া-সুন্নি বিভক্তি বা শুধু মাজহাবে বিভক্তি নয়, একই মাজহাবের মধ্যে অসংখ্য উপদলও রয়েছে। এসব উপদল একজন অন্যজনকে কাফের ফতোয়া দিয়ে রেখেছে, এমনকি একদল অন্য দলকে ‘কাবিলে গারদানজানি’ বা ‘গলা কেটে হত্যার যোগ্য’ হিসেবেও ফতোয়া দিয়ে রেখেছে। এমতাবস্থায় কোন একটি উপদল যদি সরকারকে এবং আইনী ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে সমর্থ হয়, তবে বাকি মুসলিমদের জন্য দেশ বসবাসের উপযুক্ত থাকবে না। তাই তিনি সংখ্যালঘুদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজনে যতটুকু ভাবতেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ভাবতেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের নিরাপত্তার প্রয়োজনে।

বঙ্গবন্ধু মুসলিমদের সাম্রাজ্যের ইতিহাসে ধর্মনিরপেক্ষ নীতির কারণে উত্থান দেখেছিলেন এবং সাম্প্রদায়িক হওয়ার কারণে পতনও দেখেছিলেন। মুসলিমদের স্বর্ণযুগ বলা হয়, আব্বাসীয় খেলাফতের সময়কে। সেই খেলাফত বিবেচনা করলে দেখা যায়- তা ছিল সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় বড় পদের অনেকগুলোই দেখা যায় অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান। দেখা যায় বিভিন্ন রকম ধর্ম বা মতের নির্ভয় চর্চা, এমনকি ধর্মত্যাগীদেরও নিরাপত্তা। সেই আব্বাসীয় খেলাফত আশারীর আন্দোলনের পর থেকে ক্রমশ সাম্প্রদায়িকতার বিষে বিষাক্ত হতে হতে নিস্তেজ হয়ে যায়। এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে ইতিহাসে। বঙ্গবন্ধু এসব বিবেচনায় নিয়ে আমাদের জন্য, সব ধর্মের ও সব ফেরকার মানুষের নিরাপদ বসবাস ও ধর্মচর্চার স্বাধীনতার যে আদর্শ দাঁড় করিয়েছিলেন, সেটিই তার ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে এবং ক্রমশ উন্নত হতে হলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সঠিক ও সার্বিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা এবং চর্চা করার কোন বিকল্প নেই। এই আদর্শ আমাদের প্রতিরক্ষা প্রাচীর।

লেখক : তথ্য প্রযুক্তিবিদ ও উদ্যোক্তা সদস্য, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড

সৌজন্যেঃ দৈনিক জনকণ্ঠ

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত