১০ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ সরকার’ এর সুবর্ণ জয়ন্তী

3508

Published on এপ্রিল 10, 2021
  • Details Image

সুভাষ সিংহ রায়ঃ

কেউ বলেন প্রবাসী সরকার, কেউ বলেন মুজিব নগর সরকার, কেউ বলেন অস্থায়ী সরকার, কেউ বলেন বিপ্লবী সরকার; আসলে কোনওটাই সঠিক নয়। প্রকৃতার্থে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার। ২০২১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের সুবর্ণ জয়ন্তী।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত ১২টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্পষ্ট করে ঘোষণা করেছিলেন ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। তার এক ঘণ্টা ১০ মিনিট পরে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর বাসা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

সবচেয়ে দুভাগ্যের ব্যাপার বঙ্গবন্ধু কেন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, কেন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাননি- এটা নিয়ে বিগত ৪৫ বছর বছর যাবৎ কুতর্ক করার চেষ্টা করা হয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের কোনও এক সময়ে ড. মাযহারুল ইসলাম , প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রাহাত খান, বাংলা একাডেমির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি তো গ্রেপ্তার এড়াতে পারতেন? প্রশ্নোত্তরে বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল একেবারেই স্পষ্ট-

২৫শে মার্চ (১৯৭১) রাতে আমি গ্রেফতার হবার আগে স্বাধীনতার ঘোষণা দেই। পুলিশ হেডকোয়াটার্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেসে সে ঘোষণা সব জেলা সদরে পাঠানো হয়। আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ করে যাই। তা না হলে তোমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য সহযোগিতা পেতে না।

আমরা প্রশ্ন করলাম কিন্তু আপনি কেন ওদের হাতে ধরা দিলেন। তিনি বললেন, ‘এ ব্যাপারে আমার বেশ ক’টি চিন্তা কাজ করেছে। এক. আমাকে ধরতে না পারলে ওরা আরও বেশি লোককে খুন করতো; দুই. আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক বলে প্রমাণিত হতাম এবং এতে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা কমতো এবং আরও বেশি দেশ আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতো। আর একটা কথা বলি, তোমরা কিভাবে নেবে জানি না, প্রফেসর সাহেব আমার সঙ্গে একমত হবেন কিনা তাও বলতে পারি না- তবে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় আমার দুঃখী বাঙালিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন বেড়েছে তেমনি মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার একটা বিশাল প্রতীক মনে মনে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুব বড়ো একটা শক্তি। আমি প্রবাসী সরকারে থাকলে শুধু প্রমাণ সাইজের মুজিবই থাকতাম। ওদের হাতে বন্দি থাকায় আমি এক মহাশক্তিধর ও বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার ভূমিকায় স্থান পাই। মানুষ আমার নাম দিয়ে হেলায় হেসে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কি অমোঘ অস্ত্র ছিলো, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতো, তাহলে আমি আরো বড়ো প্রতীকে পরিণত হতাম। বাংলার মানুষ আরো লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করতো। তাছাড়া, আমার জাতি আমাকে যে মর্যাদা দিয়েছে তার প্রতি সম্মান রেখেই আমি আমার বুঝ মতো ব্যবস্থা নিয়েছি, আর আমার দেশবাসী ও যোগ্য সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছে। (তথ্য সূত্র : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ ও অন্যান্য প্রসঙ্গ , লেখক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। প্রকাশক- দ্য রয়েল পাবলিশার্স)

আমরা খেয়াল করলেই দেখতে পারবো, পশ্চিম পাকিস্তানের বর্বরোচিত আক্রমণ শুরুর ছয়দিন পর ৩১ মার্চ ১৯৭১ ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংসদে এক আবেগপূর্ণ প্রস্তাব নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেছিলেন যা, সেটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যের কয়েকটা লাইন ছিল এরকম, “ভারতের সংসদ পূর্ব বাংলায় মানুষের গণতন্ত্রের সংগ্রামে গভীর সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করছে। ভারত শান্তি এবং মানবাধিকার রক্ষায় দায়বদ্ধ। সে কথা স্মরণে রেখে সভা অবিলম্বে অসহায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তান সরকারের বলপ্রয়োগ ও নির্মম হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার দাবি জানাচ্ছে। ভারতের সংসদ পৃথিবীর সকল মানুষকে এবং তাদের সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে দ্রুত কোনও সদর্থক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য যাতে পাকিস্তান এই গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এই সভার গভীর দৃঢ় বিশ্বাস পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের জয় হবেই। ভারতের সংসদ পূর্ব বাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করছে তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে ভারতের জনগণের পূর্ণ সহানুভুতি এবং সমর্থন থাকবে।”

লক্ষ্য করার বিষয় শ্রীমতি ইন্দিরা লোকসভায় ভাষণের দিনই ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পৌঁছেছিলেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত বিশ্বস্ত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ওই অঞ্চলের মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের বন্দোবস্তু করেছিলেন। খবর পেয়ে চলে এলেন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কে এফ রুস্তামজী। দিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করলে, সেখান থেকে রুস্তামজীকে বলা হল, তাজউদ্দীনসহ দিল্লিতে চলে আসতে। ভারতের সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। বাংলাদেশ সরকার গঠন করে, সেই সরকারের পক্ষ থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলে, দাবি পেশ করলে তিনি সহায়তা করতে পারবেন। সব মিলিয়ে এটা তার কাছে পরিষ্কার হয় গেল- গুছিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম করতে হলে, স্বাধীন সরকার গঠনের কোনও বিকল্প নেই। এ মন্ত্রিপরিষদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করা হল ১০ এপ্রিল। পাঠক নিশ্চয় মনে করতে পারবেন (লেখার শুরুতে আছে) বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান ও অন্যান্যদের বলেছিলেন, “আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যোগাযোগ করে যাই। তা না হলে তোমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য সহযোগিতা পেতে না।” সেটা আওয়ামী লীগের নেতারা ভারতে যাওয়ার সাথে সাথে তা স্পষ্ট করে বুঝতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম আর উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধু যেহেতু তখন পাকিস্তানের কারাগারে, তাই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পড়েছিল উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাঁধে। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। মন্ত্রিপরিষদের বাকি তিন সদস্য- ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান। পরের দিন, মানে ১১ এপ্রিল, প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নাম আর সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে ঘোষণা করা হয় কর্নেল আবদুর রবের নাম।

এ ঘোষণাপত্র অবশ্য ১০ এপ্রিলই প্রচার করা হয়েছিল। একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এ স্থানের নাম ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করেন। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত মুজিবনগর ছিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের রাজধানী।

দুই

বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) গণহত্যা শুরুর পরপরই ভারত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে ২৭ মার্চ এক বক্তৃতায় বলেন, “আমাদের ভূখণ্ডের একেবারে সন্নিকটে নিরস্ত্র ও নিরপরাধ মানুষের ওপর যে নজিরবিহীন নির্যাতন চলছে, আমাদের জনগণ তার তীব্র নিন্দা না করে পারে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের এই মহান সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের প্রতি সমর্থন ও সহৃদয় সহানুভূতি অব্যাহত থাকবে।”

৩১ মার্চ লোকসভা ও রাজ্যসভার যৌথ অধিবেশনে পাকিস্তান সরকারের প্রতি তীব্র নিন্দা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করা হয়। ১ এপ্রিল ১৯৭১- এর জাতিসংঘে নিযুক্ত ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন নির্লিপ্ত জাতিসংঘের সমালোচনা করে একটি বার্তা মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করেন। ওই বার্তায় বলা হয়, “বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে তা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মনে করে চুপচাপ থাকার সময় আর নেই। মানব-দুর্গতির এ মুহূর্তে জাতিসংঘের নিস্ক্রিয়তা ও নীরবতাকে দুর্গত জনগণ উদাসীনতা মনে করবে।”

এখানে একটি বিশেষ তথ্য উপস্থাপন করা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের লোকসভায় ৯২টা অধিবেশনের মধ্যে ২৯৬ বার বাংলাদেশ বিষয়ক নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল ।


ইন্দিরা গান্ধী পরামর্শ দিয়েছিলেন, এক সরকার গঠন করা হলে ভারতের জন্য কাজ করতে সুবিধা হবে। ২০১৯ সালে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বীরবিক্রম ড. তোফিক এলাহী বলেছিলেন, “পুরো আয়োজন করা হয়েছিল খুবই গোপনে। এমন একটি জায়গা বাছাই করতে বলা হয়েছিল যেখানে ভারত থেকে সহজেই ঢোকা যায়, যে এলাকা শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে- বিশেষ করে আকাশ থেকে।” উল্লেখ্য জনাব তৌফিক এলাহী তখন মেহেরপুরের মহাকুমা প্রশাসক ছিলেন। তার বর্ণনা মতে, “লেফটেন্যান্ট কর্নেল চক্রবর্তী নামে বিএসএফর একজন কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় বৈদ্যনাথতলার আমবাগানটি বাছাই করা হলো। সেখানে আমবাগান থাকায় আকাশ থেকে সহজে দেখা যায় না। মেহেরপুর থেকে ১০/১২ কিলোমিটার দূরত্বে হলেও রাস্তাঘাট নষ্ট থাকায় সহজে যাওয়া যায় না। আবার ভারত থেকে সহজেই সেখানে প্রবেশ করা যায়।”

বেশ কিছু বিদেশি সাংবাদিকসহ কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। বৈদ্যনাথতলায় একটি মঞ্চ বানানো হয়েছে। মঞ্চে থাকা চেয়ারগুলোর মধ্যে একটি খালি রাখা হয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য। সেখানে ডিক্লারেশন অব ইন্ডিপেন্ডেন্স পাঠ করলেন গণপরিষদের স্পিকার ইউসুফ আলী। তিনিই ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। শপথ গ্রহণের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বক্তৃতা করেন। কলকাতায় পাকিস্তানের উপ-দূতাবাসে উপ-হাইকমিশনার পদে ছিলেন বাঙালি অফিসার হোসেন আলী। বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরপরই হোসেন আলীর নেতৃত্বে উপ-দূতাবাসে কর্মরত প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। কলকাতায় উপ-দূতাবাসে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওঠান হোসেন আলী। ক্ষুব্ধ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি পাঠায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। পাকিস্তান দাবি জানায়, কলকাতায় উপ-দূতাবাসে যেসব বাঙালি কর্মকর্তা বিদ্রোহ করেছে তাদের যেন ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু তাদের বহিষ্কার করতে অস্বীকৃতি জানায় ভারত। চিঠিতে পাকিস্তানের তরফ থেকে বলা হয়, কলকাতায় উপ-দূতাবাসে পাকিস্তান নতুন একজন উপ-হাইকমিশনার নিয়োগ করেছে। যেসব ব্যক্তি কলকাতার উপ-হাইকমিশন অবৈধভাবে দখল করে আছে তাদের সেখান থেকে উচ্ছেদ কারার দাবি জানানো হয় পাকিস্তানের তরফ থেকে। কিন্তু ভারত সেটি করেনি। ভারতের তরফ থেকে পাকিস্তানকে জানানো হয়, পূর্ব পাকিস্তানের যারা বিদ্রোহ করেছে তাদের উচ্ছেদ করা হবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবিতে ১৯৭১ সালের ১ অগাস্ট লন্ডনে বড় বিক্ষোভ হয়।

কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশ সরকার শুরুতেই বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধের পাশাপাশি যে কাজটি করা দরকার সেটি হচ্ছে কূটনীতিক তৎপরতা বাড়ানো। বাঙালিরা কেন যুদ্ধ করছে সে বিষয়টি আন্তজার্তিক সম্প্রদায়কে বোঝানো অপরিহার্য ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতায় ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সভাপতি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়। সভায় নেওয়া এক প্রস্তাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যা ও অত্যাচার বন্ধ করতে জাতিসংঘ ও বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানোসহ দরকারি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করা হয়। সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করতে ১১ এপ্রিল কলকাতায় জনসভা করা নিয়ে আলোচনা হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সহায়তা করতে কলকাতার ভারতীয় সংস্কৃতি ভবনে অন্য সভায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সমাজকর্মী ও সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করা হয় সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি নামে আরেকটি সংগঠন। এর সভাপতি নির্বাচিত হন কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। কোষাধ্যক্ষ ও যুগ্ম সম্পাদক হন যথাক্রমে সন্তোষকুমার ঘোষ ও বিনয় সরকার। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির সঙ্গে যোগ রেখে এই সমিতি কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন- মনোজ বসু ও প্রবোধকুমার সান্যালসহ বিশিষ্ট লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়সহ আরও কয়েকজন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী এই সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। একই সময়ে যুক্তরাজ্যের কমন্স সভায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গঠিত নতুন সরকার নিয়ে আলোচনা হয়।

তিন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভারতে পশ্চিম বাংলায়, অসম এবং ত্রিপুরায় প্রতিদিন লক্ষাধিক শরণার্থী উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল । তাদের দুঃখ-দুর্দশা ছিল এককথায় অবর্ণনীয়। অমানবিক অত্যাচার হয়েছে মানুষের ওপর। বাংলাদেশের মানুষ ভারতের আশ্রয়ে নিয়েছিল জীবন ও সম্মান বাঁচাতে। ভারত সরকার জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পি এন হাকসার, প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের অন্যতম সচিব ডি পি ধরকে নিয়ে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেছিলেন।

শরণার্থীদের মর্মস্পশী বেদনার কথা শুনেছিলেন। আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিল সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমান- এর বিচার করা হবে। অর্থাৎ একথা স্পষ্ট হল যে, পাকিস্তানের সামরিক আদালতের বিচারে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে ফাঁসি দেওয়া হবে। এ সামরিক বিচারের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বরে সকল রাষ্ট্রনেতার কাছে মুজিবর রহমানের প্রাণ রক্ষার আবেদন জানান। এবং ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি এবং স্থিতির স্বার্থে ইন্দিরা বিশ্বের দরবারে ভারতের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেওয়ার জন্য পি এন হাকসারকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে সোভিয়েত রাশিয়া যাত্রা করেন। মস্কোর একটি সভাতে বলেন, “বাংলাদেশে যা ঘটছে তাকে এখন আর ওই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। প্রায় এক কোটি মানুষ আমাদের দেশের আশ্রয় নিয়েছেন। ওই মানুষগুলোর কি নিজের দেশের বসবাস করার বা কাজ করার অধিকার নেই?… এখন বিশ্বের রাষ্ট্রনেতাদের দেখতে হবে যাতে এই অসহায় মানুষগুলো নির্ভয়ে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে।” সরাসরি ব্রেজনেভ এবং কোসিগিনের কাছ থেকে ইন্দিরা এই প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। রাশিয়ার এ প্রতিশ্রুতির তিন সপ্তাহ পরে ইন্দিরা ২৪ অক্টোবর পি এন হাকসার এবং বিদেশ সচিব টি এন কল-কে নিয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় জনমত তৈরির জন্য রওনা হন। ইন্দিরা বেলজিয়াম, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ব্রিটেন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ এবং ভারতের পরিস্থিতি বিদেশি সরকার এবং মানুষের কাছে তুলে ধরেন। একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতিরেকে সর্বত্র ভারতের কণ্ঠস্বরকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৪ এবং ৫ নভেম্বর দুইদিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক হয়।

মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটন প্রেস ক্লাবে ভারতের বক্তব্য তুলে ধরে বলেছিলেন “যিনি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছেন তাঁর সঙ্গে করমর্দন করা যায় না। জেনারেল খান বাংলাদেশে যা করেছেন তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছুই নয়।”

এই প্রবল উত্তেজনা এবং ব্যস্ততার মধ্যে ইন্দিরা নিউ ইয়র্কে ডরোথির সঙ্গে দেখা করেন। ডরোথির বাড়িতেই নিউ ইয়র্কের লেখক-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের সভায় পাকিস্তানের গণহত্যার বর্ণনা দেন। এবং ভারতের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা ব্যাখ্যা করেন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী লন্ডনেও নাগরিক সভায় বক্তব্য রাখেন। সর্বত্র তিনি শেখ মুজিবর রহমানের জীবন রক্ষার আবেদন জানান।

৭ জুলাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ভারতে এলেন। বাংলাদেশ পরিস্থিতি আলোচনায় কিসিঞ্জার জানালেন- বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে কোনও যুদ্ধে ভারত অগ্রসর হলে আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়াবে না। সে সময় আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় কিসিঞ্জার ভারত থেকে পাকিস্তান হয়ে গোপনে চীনে গিয়েছিলেন। সেখানে কিসিঞ্জার চৌ-এন-লাই এবং চেয়ারম্যান মাও-সে-তুঙ এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। যদিও ভারতের কাছে কিসিঞ্জারের গোপনে চীন যাত্রার খবর দেরিতে পৌঁছায়। ইন্দিরার পরামর্শদাতারা সবাই একত্রে বসলেন। পি এন হাকসার, ডি পি ধর, টি এন কল এবং এল কে ঝা ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রদূত) প্রধানমন্ত্রীকে সোভিয়েত রাশিয়ার সাহায্য নিতে পরামর্শ দিলেন। কিসিঞ্জারের চীন-বৈঠকের এক মাস পর ‘রুশ-ভারত শান্তি বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা’ অর্থাৎ ‘রুশ-ভারত মৈত্রী’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। সোভিয়েত বিদেশমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো ৯ অগাস্ট ১৯৭১ দিল্লিতে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই সংবাদ জানার পরই ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসির আদেশ দিতে ভয় পেয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি ছিলেন ২৮৮ দিন । দেশে ফিরে এসে মাত্র ৩২৫ দিনের মধ্যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন । ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই সরকারের মূলভিত্তি ছিল চার মূলনীতি- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ। একদিক দিয়ে বাংলাদেশ সরকার ভারত থেকে এগিয়ে ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংযোজন করেছিল ১৯৭৭ সালে।

এ বিষয়ে সবচেয়ে চমৎকার উত্তর দিয়েছেন ভারতের সাবেক কূটনীতিক শঙ্কর এস ব্যান্যার্জ্জী তার এক বইতে উল্লেখ করেছেন এভাবে-

“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মিটিং এর শেষ প্রান্তে এসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মিসেস গান্ধীর সামনে বিনয়ের সাথে একটি প্রশ্ন তুললেন যে তিনি কি অবগত আছেন যে, ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুইটি প্রকৃতপক্ষে ভারতের সংবিধানে নেই! বুদ্ধিতে হার মানতে নারাজ মিসেস গান্ধী উত্তর দিলেন- যে তিনি বিষয়টি জানেন এবং পরিস্থিতি অনুকূলে এলেই তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টিয়ারি সিস্টেমের মধ্যে থেকেই এটি সংশোধনের চেষ্টা করবেন। মিসেস গান্ধীর প্রায় ৫ বছর লেগেছিল ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ, লোকসভায় ভারতীয় সংবিধানের ৪২ তম সংশোধনী হিসেবে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ শব্দ দুইটি উপস্থাপন করতে। এই দুইটি জটিল শব্দ কার্যকরী হয় ১৯৭৭ সাল থেকে। বিচারপতি চৌধুরীর সেই কথাটা হয়তো ভারতীয় সংবিধানে ব্যক্তিগত সহায়তার মতোই বিবেচিত হবে। আমাকে যখন ইন্দিরা গান্ধী এবং আবু সাঈদ চৌধুরীর মিটিং এর রেকর্ডস রাখার জন্য উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তখন আমি অতটা আঁচ করতে পারিনি যে এটি এমন একটি ঐতিহাসিক মিটিং হবে।”

লেখকঃ রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সৌজন্যেঃ bdnews24.com

Live TV

আপনার জন্য প্রস্তাবিত